প্রদীপ কুন্ডু, তুফানগঞ্জঃ কোচবিহার তথা উত্তর বঙ্গে আবহমান কাল থেকে লোকসঙ্গীতে বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্রের প্রয়োগ দৃষ্ট হয়। বিশেষ করে কীর্তনাঙ্গে ব্যবহৃত বাদ্য যন্ত্রের মধ্যে অন্যতম হল সারিন্দা, আখড়াই, খোল,ঝাঁপতাল, করতাল প্রভৃতি। এর মধ্যে সারিন্দা হল এক ধরনের তার বাদ্য যন্ত্র বিশেষ। ছাতিম গাছের কাঠ সাধারণত এই বাদ্য যন্ত্র তৈরির জন্য উপযুক্ত। ছাতিমের অভাবে নিম, কাঁঠাল দিয়েও তৈরি করা যায়।
একটি ২/২.৫ ফুট দীর্ঘ ও ২ ফুট গোলাকার কাঠকে কেটে এই বাদ্য যন্ত্র তৈরি করা হয়। নীচের দিকে গর্তের মত সুরের উৎসস্থানটিকে গোসাপের চামড়া দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয়। বর্তমানে গোসাপের অপ্রতুলতার জন্যে ছাগলের চামড়া দিয়েও আচ্ছাদিত করা হয়। সারিন্দায় একটি করে ব্যোম, জিন ও সুরের মোট তিনটি তার থাকে। রগ সুতাকে তার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সারিন্দা ছড়া বা ছড়ি দিয়ে বাজানো হয়। সাধারণত ঘোড়ার পুচ্ছকেশ দিয়েই ছড়া বা ছড়ি তৈরি করা হয়ে থাকে।
ঘোড়ার পুচ্ছকেশের অভাবে চাও গাছের গুড়ি দ্বিখণ্ডিত করে কিছু দিন ফেলে রেখে গুড়ির মধ্যাংশ থেকে সংগৃহীত তন্তু বিশেষ দিয়েও ছড়া বা ছড়ি তৈরি করা হয়। তুলনামূলকভাবে ঘোড়ার পুচ্ছকেশ নির্মিত ছড়া বা ছড়ি দিয়ে সারিন্দা বাজালে অধিক সুললিত সুর উত্থিত হয়। সারিন্দা গোসাপের চর্মাচ্ছাদিত হলে আরও সুমিষ্ট সুর সৃষ্টি হয়ে থাকে। কোচবিহার জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে এখনো বহু সারিন্দা বাদকের দেখা পাওয়া যায়। কোনো স্বীকৃতি বা প্রাপ্তির আশা না করে এরা নিরবচ্ছিন্নভাবে সুর সাধনা করে যাচ্ছেন। এদের কথা হয়ত কোথাও লেখা থাকবে না। সুবৃহৎ লোক সংস্কৃতি জগত যে এদেরও সামান্যতম অবদানে পুষ্ট তা হয়ত কেউ মনে রাখবে না।
এনার নাম উপেন্দ্রনাথ বর্মন। তুফানগঞ্জ মহকুমার নাটাবাড়ি-২ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন ২য় খণ্ড বাজেজমা চিলাখানা গ্রামে বাড়ি। বয়স ৬৩ বছর। ৪০ বছর ধরে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সারিন্দা বাজিয়ে চলেছেন।বাবা রাজেন্দ্রনাথ বর্মনের কাছেই তার সারিন্দা বাজানোর হাতে খড়ি। একসময় একনামের দলে সারিন্দা বাজাতেন। সরকারি ‘শংসাপত্রও পেয়েছিলেন। বর্তমানে আর পেশাদারি কোনো দলে বাজান না। পাড়ার কীর্তনের দলেই শুধু মাত্র বাজান।কীর্তনও করেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রীকে নিয়ে দু’জনের পরিবার।কোন শিল্পী ভাতাও পান না।
পৌরাণিক কাহিনী মতে, একটি জনশ্রুতি আছে যে একবার শিব ও পার্বতীর মধ্যে প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব হওয়ায় পার্বতী রাগ করে পিতৃগৃহে গমনে উদ্যোত হলে শিব নিজ অঙ্গ থেকে একটি বাদ্য যন্ত্র সৃষ্টি করেন। সত্ত্ব,রজ,তম এই ত্রিগুণের প্রতীকই হল এই বাদ্য যন্ত্রের তিনটি তার(সুর,জিন ও ব্যোম)। এই বাদ্য যন্ত্রে মনমোহিনী সুর বাজিয়ে শিব পার্বতীর মানভঞ্জন করে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এই বাদ্য যন্ত্রটিই হল সারিন্দা। হিমালয়ের পাদদেশ শিবের বিচরণ ক্ষেত্র বলে বলে কথিত। স্বাভাবিকভাবেই হিমালয়ের পাদদেশ কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, নিম্ন অসম, নিম্ন নেপালের কিছু অঞ্চলে সারিন্দার উৎপত্তি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই অঞ্চলগুলিতে একসময় সারিন্দার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তবে আজ আর তেমনভাবে সারিন্দার সুর শোনা যায় না।