খবরিয়া ২৪ নিউজ ডেস্ক, ৯ আগস্ট, কলকাতা: বৃহস্পতিবার প্রয়াত হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর প্রয়াণের পর রাজনীতীর রং ভুলে যখন শোকস্তব্ধ আপামর বাঙালি সেই সময়ে কার্যত অন্য পথে হাঁটলেন লেখিকা তসলিমা নাসরিন। ফেসবুকে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে লম্বা পোস্ট করেছেন তিনি। কিন্তু তাতে শোকের চিহ্নমাত্র নেই। বরং লেখিকা স্পষ্ট বলেছেন, তাঁর চোখের জল বেরোবে না!
ফেসবুক পোস্টে লেখিকা জানান, ‘বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মারা গিয়েছেন… ২০০৩ সালের আগে এরকম খবর শুনলে আমি হয়তো চোখের জল ফেলতাম। কিন্তু তিনি আমার চোখের জল অনেক বছর ঝরিয়েছেন। তিনি বেঁচে থাকাকালীন। তাই চোখ থেকে আজ কোনও জল ঝরল না তাঁর জন্য। আসলে কোনও জল আর অবশিষ্ট নেই।’
তসলিমা জানিয়েছেন, ২০০৩ সালের আগে পর্যন্ত এই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গেই নন্দনে গিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আড্ডা দিতেন। প্যারিস থেকে বুদ্ধ ভট্টাচার্যর জন্য উপহার নিয়ে আসতেন। কিন্তু, সেই সম্পর্ক বদলে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বইটি নিষিদ্ধ করার ঘটনায়। তসলিমার খেদ, “২০০২ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সখ্য ছিল। তারপর তাঁর কী হল কে জানে।”
তসলিমা লিখেছেন, “সেদিনই মনে হয়েছিল আমি তাঁর চেয়ে খাঁটি বামপন্থী। আমি নাস্তিক, আমি নারীবাদী, আমি ধর্ম বর্ণ শ্রেণী লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের সমতা এবং সমানাধিকারে বিশ্বাস করি। একটি মৌলবাদি দেশে কিশোর বয়স থেকে আমার আদর্শের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করছি । আমার দ্বিখণ্ডিত বইটিতে আমি রাষ্ট্রের কোনও রকম ধর্ম থাকার বিরুদ্ধে লিখেছিলাম । রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করার জন্য লিখেছিলাম বলে তিনি আমার বই নিষিদ্ধ করেছিলেন। ভাবা যায়, একজন বড় বামপন্থী নেতা রাষ্ট্রধম ইসলাম থাকা সমর্থন করতে চান। যুক্তি দেন, তা না হলে মুসলমানরা রাগ করবে।”
লেখিকা আরও জানান, হাইকোর্টে কলকাতার মানবাধিকার সংস্থা এপিডিআর দ্বিখণ্ডিত নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা করলো। জয়ী হলো। দ্বিখণ্ডিত থেকে বুদ্ধবাবুর জারি করা নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল। তিনি আমার ওপর আগুন হয়ে রইলেন রেগে। আরে মামলা তো আমি করিনি, জয়ী তো আমি হইনি, সুজাত বাবুরা হয়েছে। এরপর থেকেই আমাকে দেশ থেকে, সম্ভব না হলে কলকাতা থেকে তাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। ২০০৭ সালে আমাকে সাড়ে চারমাস গৃহবন্দি রেখেছিলেন, যেন অতিষ্ট হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাই।
কিন্তু কোথাও যাইনি আমি। শেষ পর্যন্ত একটা কুৎসিত নাটক করে তাড়িয়েছিলেন। তারপর কী হলো? আপদ তো বিদায় হলাম। তিনি নিশ্চয়ই খুব আনন্দে ছিলেন তখন। আর অসহায় নিরীহ নির্বাসিত, নির্যাতিত, সৎ ও আপসহীন মানুষটির জীবন কতটুকু দুর্বিষহ হয়েছিল, সে কথা আজ আর নাই বললাম। শুনেছি পরে একটি বই লিখেছেন তিনি। তাঁর কী কী ভুল হয়েছিল তাঁর শাসনামলে, কী কী ভুল তিনি করেছিলেন , সবই লিখেছেন।
শুধু আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিনা দোষে যে তাড়িয়েছিলেন, সেই কথাটা উল্লেখ করেননি। এর মানে এ নিয়ে তাঁর কোনও অনুশোচনা ছিল না, তিনি মনে করতেন তিনি যা করেছিলেন ভাল করেছিলেন। আমার স্বপ্ন,সাধ সব চুরমার করে দিয়ে তিনি ভাল করেছিলেন। একজন বাংলা-অন্ত-প্রাণের কাছ থেকে বাংলাকে ছিনিয়ে নিয়ে তিনি ভাল করেছিলেন’। এপ্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও একযোগে বিঁধেছেন তিনি এই বিষয়ে বুদ্ধবাবুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলার জন্য।
পোস্টের শেষপাতে আরও বিস্ফোরক তসলিমা। লিখলেন, “আমি আত্মায় বিশ্বাস করি না। পরলোকে বিশ্বাস করি না। তাই আজ অন্য সবার মতো বলতে পারলাম না চিরশান্তিতে থাকুন। অথবা যেখানে থাকুন ভালো থাকুন ইত্যাদি। তবে তাঁর জীবনে তিনি ভালো যেসব কাজ করেছেন, তার জন্য বলব- কমরেড, লাল সেলাম।”